প্রচন্ড শীতে কুঁকড়ানো দেহটাকে টেনে কোন মতে স্কুলের বারান্দায় পা রাখে অনামিকা । পুরো বিশ কিলোমিটার পথ, পাড়ী দিয়ে রূপসার এক অজ পাড়া তে তার স্কুল।
-অতো দূর, কিভাবে যাবে তুমি ?
বলেছিলো রাশেদ । অনামিকা বলেছিলো,
-সরকারী চাকুরী, দূর হোলেও তো সোনার হরিন !
-পারবে তো শেষ পর্যন্ত, অনু ?
পারবো, নিশ্চয় পারবো ।
আচ্ছা যাও,
অনামিকার সেই তো যাত্রা, লোকে বলেছিলো অবিবাহিত মেয়ে, তার উপর অতো দূর, বিশেষ কোরে ওই এলাকাতে সর্বহারার যে ঘাটি । সব কিছু উপেক্ষা করে অনামিকা স্কুলে জয়েন করলো । জীবনের প্রথম চাকুরী, একটু শিহরণ, একটু ভয় , অন্যরকম অনুভতি সব কিছু মিলিয়ে অনামিকার খারাপ লাগেনি । স্কুলের সামনে মাঠ, রাস্তার সাথে পূজা মন্ডপ, মাঠের কিছু অংশে প্রায় সন্ন্যাসদের যজ্ঞ হোতে দেখা যায় ।
মুসলিম মেয়ে অনামিকা, হিন্দু এলাকাতে চাকুরী করতে এসে এই কালচারকে বুঝে উঠতে তার বেশ কিছু সময় লেগেছে। স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা দিদিমণি বলেই তাকে ডাকে, নতুন শব্দ, দিদি মণি ডাকটা তার ভালোয় লেগেছে ।ছিপছিপে পাতলা মেয়েটির মনের গভীরে খুব শীঘ্রই স্কুলটা একটা পাক্কা আসন করে নিলো। অতো দূর থেকে স্কুলে আসতে তার যত কষ্টই হোক নাকেন , যখন দেখতো, নদীর ঘাটে তার ছাত্র ছাত্রী বসে থাকতো, কখন দিদিমণি আসবে, তার নৌকার দাড় বেয়ে ওপার থেকে তাকে নিয়ে আসবে, নদীর ঘাটে আসলেই অনামিকা দেখট, -ওদের। ওরা চিতকার করে বলছে-দিদিমণি, তুমি অপেক্ষা করো আমরা আসছি ।
ঘাটে একটায় নৌকা ছিলো, আঠারো বাকী নদীর তলদেশের গভীরতা যেমন কম ছিলো,
নদীর দৈর্ঘও তেমন বেশি ছিলো না, চিতকার করে ডাকলেই দু'পাড়ের লোকেরা শুনতে পারতো, নৌকার স্থায়ী কোন মাঝি ছিলো না, এ জন্য মাঝে মাঝে অনামিকার নদী পারহোতে সমস্যা হোতো । সেদিন তো অনামিকা অবাকই হোয়ে ছিলো, এ পাড়েই নৌকা, আশে পাশে কেউ নেই, নাও বাইতে সে জানে না , হঠাত করে অরিন্দম, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র চিতকার করে বললো,-দিদিমণি, চিন্তা কোরো না আমি আসছি ।
চোখের পলকেই ঠান্ডা জলে ঝাপিয়ে পড়লো অরিন্দম, হায় হায় করে উঠলো অনামিকা কি করলি অরিন্দম ! প্রায় পাঁচ মিনিট পর সাঁতরে শীতে ঠক ঠক করতে করতে অরিন্দম হাজীর,-চলো দিদিমণি
অনামিকা অবাক হোয়ে তাকিয়ে আছে, একেই কি বলে শ্রদ্ধাবোধ, একেই কি বলে ভালোবাসা ?
নোউকায় অনামিকা , মাথা নিচু করে অরিন্দম নৌকা চালিয়ে ঘাটে পৌঁছালো ,অনামিকার চোখে পানি এসেছিলো, কিন্তু তা গোপনেই সে মুছে ফেললো ।
ছাত্র হিসাবে সুবিধার ছিলো না অরিন্দম ,কিন্তু ভক্তিতে এ রকম অনামিকা কমই দেখেছে ।
আজও বারান্দায় উঠতেই-একটা গাঁদা ফুল বাড়িয়ে দিলো অরিন্দম,-এটা তোমার জন্য দিদিমণি
খেঁচিয়ে উঠলেন নির্মল বাবু সেকেন্ড মাষ্টার ,-তোদের বলেছি না, উনি টাউনের মানুষ, উনাকে আপনি করে বলবি !
হেসে উঠলো অনামিকা ,-থাক না দাদা, আমার মন্দ লাগে না !
ফুলটা নিয়ে গন্ধ শুকলো অনামিকা,-ধন্যবাদ , অরিন্দম, তোর গাছের ?
নির্মল বাবু আবার চেঁচালেন,-কার বাগান থেকে আনলিরে পাঁজি ?
অরিন্দম আমার দিকে তাকিয়ে বললো,-ঠাকুর মার কাছ থেক চেয়ে এনেছি, চুরি করিনি দিদি মনি !
শীতকালটা খারাপ গেলো না, গরম আসতেই অনামিকার অসয্য লাগলো , গ্রামের লোকেরা শামুকের ব্যাবসা করে, ঘেরে মাছের চাষের জন্য লাগবে, রাস্তার দু'পাশে গ্রামের মহিলারা শামুক ভাংগে, নোংরা আর বিশ্রী গন্ধ বাতাসে, মাছের আষ্টের গন্ধ, পঁচা কাদায় শামুকের খোসা, আর বাবলার কাঁটা বিছানো , ল্যাট্রীনে মল ভাসছে , সিউরে ঊঠে অনামিকা। নৌকার ঘাট কর্দমাক্ত, পা পিছলে পতন ঠেকানো মুশকিল, নৌকার চালি ভাংগা, নদীতে দু'কুল ছাপিয়ে পানি, হঠাত হঠাত বৃষ্টি, বাড়ী থেকে দুইকিলোমিটার হাঁটার পর বাস, বাস ছেড়ে আবার হাটা এরপর নৌকা, বৃষ্টির ভিতর ঠিক এটাকে আর এডভাঞ্চার মনে হয় না অনামিকার, যে জিনিস বেশি কষ্ট দেয় তাহলো, অরিন্দম বৃষ্টিতে বসে থাকে দিদিমণির জন্য । অন্য ছাত্র ছাত্রীরা না থাকলেও অরিন্দম থাকবেই । অনামিকার জন্য রাশেদ ব্যস্ত হোয়ে পড়ে,-তোমার বদলীটা জরুরী, এভাবে আর সম্ভব নয়, অনামিকারও আর ভালো লাগছিলো না, সেও বললো,-তাড়াতাড়ি করো ।
ডিপিওতে দৌঁড়াদৌড়ি করে একমাসের ভিতর অনামিকার বদলী হোয়ে গেলো ওর বাড়ীর পাশের স্কুলে ।
আসার সময় একটি মুখ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলো,-সে অরিন্দম, তুমি চলে যাবে দিদিমণি ?
অনামিকা একবারের জন্যও অরিন্দমের দিকে ফির তাকায়নি ।
অনামিকা স্কুল থেকে এসেছে প্রায় ষোল বছর হোয়ে গেছে, ভুলে গেছে সেই স্কুলের অনেক স্মৃতি, সেই ১৯৯৫ সালের কথা, আজ ২০১২ সাল । টেলিফোনটা বেজে ঊঠলো,
অনামিকা ফোন ধরে।
কে বলছেন ?
কেমন আছো তুমি ?
আপনি কে বলছেন ?
কেমন আছ তুমি ?
কে আপনি ?
অপর প্রান্ত নিরব, টুন করে শব্দ কেটে গেলো ফোন । বিরক্ত হোয়ে ফোন রেখে দিলো অনামিকা । প্রায় সময় ফোন আসছ । অনামিকা ভীষোণ বিরক্ত । কে এই ডীষ্টার্বিং এলিমেন্ট । নাম বলবে না, -প্রথমে প্রশ্ন করতো, এখন শুধু,-হ্যালো শব্দ শুনার সাথে সাথেই কেটে দেয় লাইন ।
রহস্যটা বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেল । অনামিকার স্বামী রাশেদও বিরক্ত, ফোনের পরিবর্তে তারা মোবাইল,ব্যাবহার শুরু করলো, ফোন্টা জমা দিয়ে দিলো অফিসে ।এবার গভীর রাতে আবার মোবাইল বেজে ওঠে, এভাবে প্রায় দু'মাস পার হবার পর অনামিকা গ্রামীন ফোনের অফিসে যায়, তার একবন্ধুর সহোযোগিতায় জানতে চায় কে এই লোক ।
ওরা যার নাম বলে অনামিকা কোনদিন তার নাম শুনেছে কিনা বুঝতে পারে না, অফিস জানায় আপনি কি ওর সিমটা ব্লক করতে চান ?
অনামিকা জানায় না, আমি জানতে চায় , কে এই লোক ?
ওরা ফোন দেয়, বলে আপনি কি আমাদের অফিসে আসতে পারবেন, একজন এই সীমটা তার বলে দাবী করছেন ?
অপর প্রান্ত থেকে বলে ঠিক আছে,-আমি কাল আসছি ,
অনামিকা ঘুমিয়ে আছে, রাতের বুক চিরে বেজে ওঠে ফোন ,-কে ?
আমি,
কে আপনি ?
আমি, তুমি চিনতে পারো না, তোমাকে আমি সব থেকে বেশি ভালোবাসি, তাতে পাপ নেই।
কে আপনি ?
আমি অরিন্দম, আমি জানি তুমি আমার নামে অভিযোগ করেছো বলে ওরা আমাকে যেতে বলেছে , কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, সত্যিকারে ভালোবাসি, কতবার তোমা্র সামনে যেতে চেয়েছি, কিন্তু কিভাবে বলতাম, সেই কচিমনে, তার থেকে দশ বছরের বড় একজন শ্রদ্ধার পাত্রীকে সে ভালোবাসে, তারপর ছায়ার মতো তোমাকে অনুসরণ করেছি, তুমি আমাকে কখনো চেনোওনি, একদিন বইয়ের রিপ্রেজেন্টিভ সেজেও তোমার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, তবু তুমি আমাকে চেনোনি, এই কথা গুলো কোনদিন তোমার মুখো মুখি হোয়ে বলতে পারতাম না । আমি আগ্মীদিন মালএশিয়া শ্রমিকের ভিসা নিয়ে চলে যাচ্ছি, যাবার আগে এই সত্যি কথাটা তোমাকে বলে গেলাম, আর কখনো তোমাকে বিরক্ত করবো না, আর কোনদিন তোমার সামনে যেয়ে বলবো না, দিদিমণি তোমার জন্য ফুল এনেছি, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও ।
অনামিকা শুনছিলো, নিথর হোয়ে, সেই কচিমুখের অরিন্দমকে, চিতকার করে বলছে দিদিমণি তুমি ভয় পেও না আমি নৌকা নিয়ে আসছি ।
হ্যাল, হ্যালো, অনামিকা দেখলো লাইন কেটে দিয়েছে, আবার ফোন দিলো সে,ওপার থেকে জানলো এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না,
অনামিকার দু'চোখের কোন দিয়ে ঝরে পড়লো দু'ফোঁটা অশ্রু ।